স্মৃতি, ইতিহাস আর স্বপ্নের বাঁকে বাঁকে জেগে থাকা এক দীপ্তিমান নাম- মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। ছাতকের দক্ষিণাঞ্চলে, বটেরখাল নদীর ত্রিমোহনার ঠিক দক্ষিণ পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বিদ্যাপীঠ, যা একশত বছরের অধিককাল ধরে জাতির চিত্তে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে, নিরলসভাবে। এটি শুধু একটি বিদ্যালয় নয়, এটি এক উজ্জ্বল বাতিঘর, যার আলোকরশ্মিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আলোকিত হয়েছে, মানুষ হয়েছে।
১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি তখনকার সুনামগঞ্জ মহকুমার প্রত্যন্ত জনপদ দোলারবাজার, ছৈলা আফজালাবাদ, ভাতগাঁও, খুরমা, সিংচাপইড় ইউনিয়নের বুকে শিক্ষার আলো জ্বালাতে যাত্রা শুরু করে। এই অঞ্চলের শিক্ষানুরাগী জনমানুষের আত্মত্যাগ, দানশীলতা ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই গড়ে ওঠে এই মহান বিদ্যাপীঠ। সে সময় যখন সমাজে শিক্ষার আলো সবার কাছে পৌঁছায়নি, তখনই জন্ম নেয় মঈনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এই আলোকযাত্রা।
প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আজ আমরা যারা এই স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক, শুভানুধ্যায়ী- আমরা প্রত্যেকে এ ঐতিহ্যবাহী অভিযাত্রার অংশীদার। মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেবলমাত্র পাঠদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, এটি যুগে যুগে গড়েছে মানুষ, সৃষ্টি করেছে নেতৃত্ব, জাগিয়েছে আত্মচেতনা। বিদ্যালয়টি শুধু কালের সাক্ষীই নয়, ইতিহাসের-এ নিজেই এক ইতিহাস। কেবল জ্ঞানের আলো বিতরণই নয়, আছে আরো অনন্য ভূমিকাও। এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অবস্থানে সকলেই সমুজ্জ্বল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়াচ্ছেন অনেক মেধাবী মুখ। বয়ে এনেছেন অনেক খ্যাতিও। সরকারের সচিব, পুলিশের উচ্চর কর্মকর্তা, ব্যাংকার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানী, দেশে-বিদেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক, খ্যাতিমান আইনজ্ঞ, শিল্প উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সাংবাদিক- এমন বহুমুখী ও কীর্তিমান মানুষ সৃষ্টির সূতিকাগার- আমাদের মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ।
এ বিদ্যালয়ের গর্বিত ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও পরিবর্তনের সাথে। ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণজাগরণ এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ- সব জায়গায় এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণের ভূমিকা স্মরণীয়। অনেকেই সরাসরি যুদ্ধ করেছেন রণাঙ্গণে, অনেকেই কাজ করেছেন সংগঠক হিসেবে। এ স্কুল শুধু আলোকিত মানুষ তৈরি করেনি, তৈরি করেছে মুক্ত মানুষ- চেতনাসম্পন্ন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ।
শিক্ষার প্রথম হাতছানি এসেছিল পার্শ্ববর্তী রাউলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাটির ঘ্রাণমাখা শ্রেণিকক্ষ থেকে। সেখানেই প্রথম হাতে কলম ধরি, প্রথম শুনি ‘অ’ থেকে ‘আ’-এর গল্প, শিখেছিলাম বর্ণমালার গান, জীবনের প্রথম ছন্দ ও শৃঙ্খলা। সেই কোমল হাত ধরে ধাপে ধাপে উঠে এসেছি জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে, যেখানে ছিল শুধুই কৌতূহল আর কাঁদা মাখা পা। তারপর মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখে ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন হয় আমার মাধ্যমিক শিক্ষার এক স্বর্ণালী অধ্যায়।
শৈশব ও কৈশোরের অমলিন আনন্দ, কাঁদা-মাটিতে গড়া দুপুর, শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চ, মাঠের দৌড় পেরিয়ে ছুটে চলা স্বপ্ন—সবই জড়িয়ে আছে এই বিদ্যালয়ের পরতে পরতে। শিক্ষকদের মুখভরা দৃঢ়তা ও ভালোবাসায় গড়া প্রতিটি পাঠ আমাকে গড়েছে একটু একটু করে। আমার পথচলার প্রতিটি স্তরে স্নেহময় শিক্ষকদের তর্জনী ছিল পথপ্রদর্শক দীপশিখা। এই প্রাঙ্গণই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে হতে হয় আলোয় বিশ্বাসী, সততা ও দায়িত্ববোধ ও সাহসে পরিপূর্ণ। আমার ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ আর জীবনের ভিত গড়ে দেওয়া এ বিদ্যালয়—আমার দ্বিতীয় জন্মভূমি। শুধু পরীক্ষার খাতা নয়, জীবন বোঝার পাঠও এই বিদ্যালয় থেকে পেয়েছি। এই বিদ্যালয় ছিল শুধু পড়ার স্থান নয়, ছিল স্বপ্ন দেখার জানালা। যে স্মৃতিগুলো চোখে নয়, হৃদয়ে গাঁথা- এটি আজও আমার হৃদয়ের এক নিরব কান্না, এক নির্ভর ভালোবাসার নাম।
২০২৮ সালে বিদ্যালয়টি একশত বছরে পদার্পণ করবে- এই একশত বছরের আলোকরেখা ধরে আমরা এগিয়ে চলতে চাই এক মহাউৎসবের দিকে। এই শতবর্ষ উদযাপন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক আত্মপরিচয়ের সন্ধান, এক ইতিহাসের পুনর্পাঠ। অতীতকে সম্মান জানিয়ে বর্তমানকে জাগিয়ে তুলে ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা সঞ্চয়ের এক অনন্য মুহূর্ত।
শতবর্ষ উদযাপনের এই সময়টিকে সামনে রেখে আসুন, আমরা ভাবি- একটি সংগঠিত, সক্রিয় অ্যালামনাই গঠনের কথা। এটি হবে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি মিলনমঞ্চ, যেখান থেকে শুধু স্মৃতিচারণ নয়, স্কুলের উন্নয়নে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে। ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, উন্নয়ন প্রকল্প, গ্রন্থাগার বা বিজ্ঞানাগার আধুনিকীকরণ, প্রযুক্তি সহায়তা- এসবই হতে পারে অ্যালামনাইয়ের হাত ধরে বাস্তবায়িত।
শুধু স্মৃতি আর গর্ব নয়, আমাদের এই প্রয়াসে থাকতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর। অনেক সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা দারিদ্র্যের কারণে মাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছাতে পারে না। আমরা যদি শতবর্ষ উপলক্ষে একটি “শতবর্ষ শিক্ষা/বাস্তবায়ন সহায়তা তহবিল” গঠন করতে পারি, তবে সেটি হবে মঈনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়।
শতবর্ষ উদযাপনের কাজ বিশাল। অনুষ্ঠান আয়োজন, স্মারক প্রকাশনা, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংযুক্তিকরণ, কৃতীজনদের সংবর্ধনা, সাংস্কৃতিক আয়োজন—প্রতিটি অংশই সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাপেক্ষ। তাই এখন থেকেই এই কাজের পরিকল্পনা শুরু করা সময়ের দাবি। ২০২৮ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসকে ধরে আমরা যদি এখন থেকেই প্রস্তুতি নেই, তাহলে একটি স্বার্থক ও গর্বের উৎসবের আয়োজন করা সম্ভব হবে। এই আয়োজনে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একত্র করার জন্য ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল, স্থানীয় পর্যায়ের মিটআপ- এসব কৌশল কাজে লাগানো যেতে পারে।
এই শতবর্ষ যেন হয়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের পুনর্মিলন, পুরনো ক্লাসের গন্ধভরা দুপুরের পুনর্জাগরণ, মাধুর্যময় একটি অধ্যায়ের সম্মিলিত স্মরণ। আমরা যদি সবাই মিলে, ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাই, তবে এই অনুষ্ঠান হবে কেবল একটি আয়োজন নয়, এটি হয়ে উঠবে এই জনপদের শিক্ষা-সংস্কৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় আজ যে গৌরবময় অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তা একদিনে হয়নি। এটি হয়েছে একশত বছরের ধৈর্য, শ্রম, স্বপ্ন আর বিশ্বাসের সমষ্টিতে। আমরা যারা এর অংশ, তারা শুধু সৌভাগ্যবানই নই, বরং আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই ঐতিহ্যকে ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের প্রধান কাজ।
মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় আমাদের আত্মার সঙ্গে জড়ানো এক নাম, আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। শতবর্ষের এই সম্ভাব্য আয়োজন হোক আমাদের এক হয়ে পথ চলার প্রতিশ্রুতি। এক আলোকময় আগামী গড়ার জন্য আমরা যেন একসঙ্গে এগিয়ে চলি- এই হোক আমাদের শতবর্ষের শপথ।
✍ লেখকঃ
ডা. ফয়সল আহমদ বাবুল
এমপিএইচ, এমডিএস, এমএড
শিক্ষক, চিকিৎসক,
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, এসএসসি ১৯৯৮, মঈনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :