কিডনি সুরক্ষায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা : ডা. ফয়সল আহমদ বাবুল


sylnews24 প্রকাশের সময় : মার্চ ১২, ২০২৫, ৮:০৫ অপরাহ্ন /
কিডনি সুরক্ষায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা : ডা. ফয়সল আহমদ বাবুল

বিশ্ব কিডনি দিবস প্রতি বছর মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হয়। আজ ১৩ মার্চ ২০২৫ বৃহস্পতিবার সারা বিশ্বে পালিত হবে বিশ্ব কিডনি দিবস। এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “আপনার কিডনি কি সুস্থ? প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করুন, কিডনি স্বাস্থ্য রক্ষা করুন”। এই প্রতিপাদ্য আমাদের কিডনি সুস্থ রাখার গুরুত্ব এবং প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করে প্রতিরোধের উপর গুরুত্বারোপ করে। কিডনি আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শরীর থেকে দূষিত পদার্থ ও অতিরিক্ত তরল অপসারণের মাধ্যমে সুস্থতা বজায় রাখে। প্রাকৃতিক ও সমন্বিত উপায় হিসেবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি কিডনির সুস্থতা রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর, কারণ এটি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ করে।

আয়ুর্বেদ মতে, কিডনি রোগ প্রধানত বাত, পিত্ত ও কফ দোষের ভারসাম্যহীনতার কারণে হয়। বাত দোষ কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা হ্রাস করে। পিত্ত দোষ প্রদাহ ও কিডনি কোষ ধ্বংস করতে পারে। কফ দোষ শরীরে বিষাক্ত টক্সিন জমিয়ে কিডনিকে দুর্বল করে। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অপর্যাপ্ত পানি পান, দূষিত পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অতিরিক্ত প্রোটিন, লবণ ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, অধিক মানসিক চাপ এবং অনিয়মিত জীবনযাত্রার কারণে কিডনির কার্যকারিতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে পারে। আয়ুর্বেদ কিডনির যত্ন নিতে প্রধানত সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ভেষজ উপাদান, যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম এবং আয়ুর্বেদিক ডিটক্সিফিকেশন বা পঞ্চকর্ম চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব দেয়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা মূলত শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ করার উপর গুরুত্ব দেয়, যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে এবং কিডনি তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে পারে। তাই কিডনি সুস্থ রাখতে আয়ুর্বেদিক নিয়মকানুন অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শরীর সুস্থতা এবং কিডনি সুরক্ষায় আয়ুর্বেদ সুষম খাদ্যাভ্যাসের উপর জোর দেয়। শাকসবজি ও ফলমূল যেমন- শশা, গাজর, লাউ, টমেটো, আমলকী, ধনিয়া ও মৌরি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে এবং শরীরের পানি ও লবণের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিডনির সুস্থতা এবং কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা শরীর থেকে টক্সিন অপসারণে সহায়তা করে। অতিরিক্ত লবণ ও চিনি গ্রহণ, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কিডনির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাই এগুলো পরিহার করা উত্তম।

কিডনি সুরক্ষায় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ভেষজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুনর্ণবা বা গন্ধপূর্ণ (বোয়েরহাভিয়া ডিফুসা) কিডনি ডিটক্সিফাই করে ও প্রদাহ কমায়, বরুণ (ক্র্যাটায়েভা রিলিজিওসা) কিডনি সংক্রমণ দূরীকরণে সহায়ক, গোখরু ( ট্রিবিউলাস টেরেস্ট্রিস) কিডনি পাথর প্রতিরোধ করে, গিলয় বা গুলঞ্চ, (টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে আর শতাবরি বা শতমূলী (অ্যাসপারাগাস রেসিমোসাস) প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত ভেষজ চা যেমন- ধনিয়া ও মৌরি চা, গিলয় ও তুলসি চা এবং মেথি ভেজানো পানি পান কিডনির কার্যক্ষমতা উন্নয়নে সাহায্য করে।

কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বিভিন্ন যোগব্যায়াম ও প্রাণায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়। নিয়মিত যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম কিডনি সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর। বিশেষ করে ভুজঙ্গাসন, পশ্চিমোত্তনাসন, শলভাসন ও মার্জারাসন কিডনির রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, প্রদাহ হ্রাস করে এবং ফিল্টারিং ক্ষমতা উন্নত করে। কপালভাতি ও অনুলোম-বিলোম প্রাণায়াম শরীরকে টক্সিন্মুক্ত করতে সাহায্য করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত ধ্যান ও মেডিটেশন মানসিক চাপ কমিয়ে কিডনি সুস্থ রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

শরীরের টক্সিন দূর করতে আয়ুর্বেদিক ডিটক্স পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। পঞ্চকর্ম চিকিৎসার মধ্যে বস্তি চিকিৎসা (ঔষধযুক্ত এনিমা), স্নেহপান থেরাপি এবং অন্যান্য ডিটক্স পদ্ধতি শরীর থেকে অতিরিক্ত দূষিত পদার্থ বের করে কিডনিকে সুস্থ রাখে।

সুস্থ কিডনির জন্য আয়ুর্বেদিক জীবনধারার অনুসরণ অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করা, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার এবং নিয়মিত প্রস্রাব ও কিডনি পরীক্ষা করা। রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ অতিরিক্ত ওজন ও উচ্চ রক্তচাপ কিডনির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কৃত্রিম ওষুধের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে কিডনির সুস্থতা বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করে।

বিশ্ব কিডনি দিবসে কিডনি সুরক্ষার অঙ্গীকার হোক- আমরা সবাই কিডনির যত্ন নেবো, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অনুসরণ করবো, কিডনির সুস্থতায় প্রাকৃতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারার অভ্যাস গড়ে তুলবো এবং আয়ুর্বেদিক উপায় মেনে কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ জীবন উপভোগ করবো।

লেখকঃ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সভাপতি, বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএএমএ)
সিলেট বিভাগীয় শাখা

মোবাইলঃ ০১৭১২৪৮২৭৬৫
ইমেইলঃ [email protected]