পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের জীবনে এক পবিত্র আনন্দবার্তা বয়ে আনে। এ উৎসব কেবলমাত্র কোরবানির আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা এবং সামাজিক সমতার এক অনন্য নজির স্থাপন করে। তবে এবারের ঈদ এক ভিন্ন বাস্তবতায় উদযাপিত হচ্ছে- গ্রীষ্মের শেষের দিকে প্রচণ্ড গরম, টানা বৃষ্টিপাত ও বর্ষার আগমনের সংযোগকালে। বৃষ্টিবাদল, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ এবং মৌসুমি রোগবালাইয়ের আশঙ্কা এই উৎসবের আনন্দকে কোথাও না কোথাও অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে আমরা উদাসীন হই।
ঈদের আগে ও পরের দিনগুলোতে ঘন ঘন বৃষ্টির ফলে পরিবেশ হয়ে উঠছে আর্দ্র ও অস্বাস্থ্যকর। জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব এবং কোরবানির বর্জ্য অপসারণে সামান্য অবহেলা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলতে পারে। পশু জবাইয়ের পর রক্ত ও অন্যান্য বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না হলে তা থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে পানিতে, বাতাসে এবং আশপাশের পরিবেশে। এ অবস্থায় টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া কিংবা চর্মরোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বাস্তব আশঙ্কা থেকেই যায়।
ঈদ মানেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করা এবং নানা ধরনের খাবার উপভোগ করা। মাংসের বাহারি পদ যেমন- কোরমা, কাবাব, বিরিয়ানি, ভুনা- তাতে থাকে প্রচুর তেল, মসলা ও চর্বি। একইসঙ্গে পরিবেশন করা হয় মিষ্টি, সেমাই, লাচ্ছি, দুধ-পিঠা ইত্যাদি নানা মুখরোচক খাবার। এই পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস অনেকের শরীরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিশেষত যাঁরা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য এই অনিয়ন্ত্রিত আহার মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ঈদের দিনগুলিতে বাড়তি খাটাখাটনি, রাত জাগা, মাংস কাটাকাটি, রান্নাবান্না ও অতিথি আপ্যায়নে বিশ্রামের অভাবও শরীরকে ক্লান্ত ও দুর্বল করে তোলে। স্যাঁতসেঁতে পোশাক, ভেজা পা বা অপরিচ্ছন্নতা থেকে চর্মরোগের মতো ফাঙ্গাল ইনফেকশন হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। বৃষ্টির পানি জমে থাকায় মশার বিস্তার ঘটে, ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগেরও আশঙ্কা রয়েছে।
এই বাস্তবতায় সচেতনতা ও সংযমই হতে পারে স্বাস্থ্য রক্ষার মূল চাবিকাঠি। খাদ্য গ্রহণে মিতাচার ও বাছবিচার অত্যন্ত জরুরি। অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত কিংবা মিষ্টি জাতীয় খাবার একদিনের জন্য তৃপ্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে দেহে মারাত্মক ক্ষতির জন্ম দিতে পারে। বরং প্রোটিনসমৃদ্ধ, সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান এবং নিয়মিত বিশ্রামের দিকে নজর দেওয়া দরকার। ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাঁদের খাদ্যতালিকা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক রাখা উচিত।
পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং আশপাশের পরিবেশ জীবাণুমুক্ত রাখাও ঈদের পরে স্বাস্থ্য সুরক্ষার অন্যতম বিষয়। পশুর হাড়, চামড়া, রক্ত ও অন্যান্য অংশ নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এবং দ্রুত সেগুলো অপসারণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী বর্জ্য ফেলার পাশাপাশি ব্লিচিং পাউডার, জীবাণুনাশক ছিটানো এবং নিজ নিজ বাসস্থানের আশেপাশে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত।
বৃষ্টির পানি পানের কাজে ব্যবহার না করা, ফুটানো পানি পান করা এবং শিশু ও বয়স্কদের আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে সহযোগিতা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ ঠান্ডা লাগা, জ্বর বা অস্বাভাবিক দুর্বলতা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
পবিত্র ঈদুল আজহার শিক্ষা হলো দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা। এই উৎসব যেন আনন্দের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তাও বয়ে আনে, সেটিই হোক আমাদের লক্ষ্য। ঈদ হোক স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ- এই কামনায়।
লেখকঃ শিক্ষক ও ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসক
শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক ( মাদ্রাসা), সিলেট জেলা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৪
আপনার মতামত লিখুন :