ডা. মোহাম্মদ ফয়সল আহমদ (বাবুল) : ঈদ-উল-ফিতর মুসলমানদের একটি বড় আনন্দের দিন, যা রোযার এক মাস পূর্ণ করার পর আসে। তবে এবারের ঈদ এসেছে একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতিতে, যেখানে ঋতু পরিবর্তনের কারণে রোযার শেষের দিকে প্রচুর গরম পড়েছে। দীর্ঘ রোযা পালনের পর, ঈদের দিনে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে নানা রকম খাবার, মিষ্টান্ন, ভাজাপোড়া, মাংস, বিরিয়ানি, তেলেডোবা পিঠাপুলি ইত্যাদি খাওয়া হয়। এই সময় শরীরের দিকে নজর রাখা জরুরি, অন্যতায় শরীরিক সমস্যাগুলোও বেড়ে যেতে পারে। গরমের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সামনে আসতে পারে, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই কিছু নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য এ সময়টা আরও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
ঈদ পরবর্তী শারীরিক সমস্যা নিয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গরমের এই সময়ে তাপমাত্রার ওপর সামান্য এদিক-সেদিক হলেই শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। গরমের কারণে একাধিক শরীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা), ত্বকের সমস্যা, হজমে অস্বস্তি, খাদ্যাভ্যাসে অস্বাভাবিকতা, খাদ্যে বিষক্রিয়া ইত্যাদি। তাই ঈদের দিন খাবারের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরি। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পরিমিতি মেনে চললে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সচেতন থাকলে ঈদে শরীরের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
গরমে শরীরের ডিহাইড্রেশন একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রোযা রেখে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর শরীর যখন প্রচুর পানি গ্রহণ করে না, তখন শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। এতে শরীরের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে এবং নানা রকম শারীরিক অসুবিধা হতে পারে। ফলে ঈদের দিন বিশেষত খাবারের পর পরিমাণমতো পানি, শরবত, ফলের রস বা অন্যান্য তরল খাবার খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের পানির চাহিদা পূর্ণ করা উচিত। এছাড়া যেহেতু গরম প্রচণ্ড থাকে, তাই বাইরে বের হলে হালকা রঙের জামা পরা, ছাতা ব্যবহার করা এবং শরীরের ওপরে গরম তাপ না পড়তে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঈদের খাবারের বিষয়ে একাধিক পরিবর্তন ঘটে, কারণ সারা মাস রোযার পর ঈদে মানুষ অনেক ধরনের ভোজনের দিকে মনোযোগ দেয়। এসব খাবারের মধ্যে মিষ্টি, তেলেভাজা মাংস, বিরিয়ানি ইত্যাদি অন্যতম। যেহেতু এ ধরনের খাবার সাধারণত উচ্চ ক্যালোরি এবং চর্বিযুক্ত হয়, তাই অতিরিক্ত খেলে তা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, বা ডায়াবেটিসের সমস্যাও বাড়াতে পারে। বিশেষত যেসব ব্যক্তি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের উচিত এসব খাবার সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা এবং তেলের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করা। তাছাড়া তাজা ফলমূল, সবজি এবং কম তেলযুক্ত খাবার নির্বাচন করলে শরীরের জন্য খুবই ভালো।
ঈদ পরবর্তী সময়ে শরীরের ত্বকেও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। গরমের ফলে অতিরিক্ত ঘাম এবং আর্দ্রতার কারণে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের র্যাশ, ঘামাচি, ব্রণ ইত্যাদি হতে পারে। বিশেষ করে যারা ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের উচিত মুখ এবং শরীর নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, ত্বকে অ্যালোভেরা, বেসন বা দুধের প্যাক ব্যবহার করা এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করা। বাইরে বের হলে সানস্ক্রিন মাখা উচিত এবং ঘরের ভেতরে থাকা ভাল। এছাড়া শরীরের ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে, তাই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা জরুরি।
ঈদের খাবার খাওয়ার পর অনেকেরই হজমের সমস্যা হতে পারে, বিশেষত যারা অতিরিক্ত মিষ্টি বা ভাজাপোড়া খেয়ে ফেলেছেন। এ সময়ে অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবারের কারণে বদহজম, গ্যাস, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। যারা এই ধরনের সমস্যায় ভোগেন, তাদের উচিত খাবারের পর হালকা হাঁটাহাঁটি করা, এক কাপ আদা চা বা লেবু চা পান করা এবং প্রয়োজন হলে হজম সহায়ক ওষুধ সেবন করা।
ঈদ উদযাপন শেষে গরমের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শরীরের দিকে অব্যাহত খেয়াল রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্বক, হজম, ডিহাইড্রেশন, মিষ্টি ও ভাজাপোড়া খাবারের অতিরিক্ত খাওয়া—এসবকে সীমিত করে চলতে হবে। যাদের হৃদরোগ, কিডনি, লিভার বা ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তারা যেন ঈদের দিন সঠিক খাদ্য গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়ে আরও সচেতন থাকেন।
ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে গিয়ে শরীরের প্রতি অবহেলা না করা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, যেমন নিয়মিত পানি পান, তাজা ফল ও সবজি খাওয়া, সানস্ক্রিন ব্যবহার করা এবং অতিরিক্ত তেল বা মিষ্টি খাবার পরিহার করা, শরীরকে সুস্থ রাখা সম্ভব।
লেখকঃ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আয়ুর্বেদিক কনসালটেন্ট,
সভাপতি
বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল এসসিয়েশন,
সিলেট বিভাগীয় শাখা
ইমেইল: [email protected]
আপনার মতামত লিখুন :