ডা. মোহাম্মদ ফয়সল আহমদ বাবুল : প্রতি বছর ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দ্বারা আয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ২০২৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- “জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত”- যা মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সামনে এনে একটি নিরাপদ ও সুস্থ ভবিষ্যতের পথ দেখায়। । এই প্রেক্ষাপটে আয়ুর্বেদ মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কীভাবে অবদান রাখতে পারে তা বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির গুরুত্ব নতুনভাবে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে মা ও শিশুর সুস্থতা রক্ষায় এর অবদান আজও অমলিন।
আয়ুর্বেদ ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞান, যার মূল উদ্দেশ্য হলো শরীর, মন ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে স্বাস্থ্য বজায় রাখা। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি আয়ুর্বেদও আজ সারাবিশ্বে বিকল্প এবং পরিপূরক চিকিৎসা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাতৃকালীন ও প্রসব-পরবর্তী যত্নে আয়ুর্বেদের নানাবিধ গুণাগুণ রয়েছে, যা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, মানসিক সুস্থতাও নিশ্চিত করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় আয়ুর্বেদের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও পথ্য মেনে চললে মা ও শিশু দুজনেরই স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যেমন ‘গর্ভিণী পরিচর্যা’ নামে পরিচিত আয়ুর্বেদের একটি শাখা রয়েছে যা গর্ভবতী মায়ের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক পরিচর্যার উপর গুরুত্ব দেয়। এতে খাদ্যাভ্যাস, যোগব্যায়াম, ধ্যান ও প্রাকৃতিক ওষুধের মাধ্যমে মায়ের শরীরকে সুস্থ ও শক্তিশালী রাখার উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। এ পদ্ধতিগুলো শুধু মা নয়, ভ্রূণেরও যথাযথ বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক।
প্রসবের পরে একজন মায়ের শরীর অনেকটাই দুর্বল থাকে। এই সময়টিতে আয়ুর্বেদিক তেল মালিশ, গরম পানির গোসল, নির্দিষ্ট ভেষজ খাবার ও ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে তার দেহ পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠে। এই পরিচর্যা পদ্ধতি শুধুমাত্র শারীরিক আরোগ্যেই নয়, মানসিক প্রশান্তিতেও সহায়তা করে। আয়ুর্বেদের এই পদ্ধতিগুলো গ্রামীণ সমাজে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, যা এখন আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা ক্রমেই যাচাই ও স্বীকৃত হচ্ছে।
শিশুর ক্ষেত্রেও আয়ুর্বেদ তার বিশেষ ভূমিকা রাখে। শিশুর প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে নির্দিষ্ট ভেষজ যেমন গিলয়, অশ্বগন্ধা বা তুলসী প্রয়োগ করা হয়। ‘সুর্ণ প্রাশন’ নামে এক বিশেষ আয়ুর্বেদিক টনিক শিশুর বুদ্ধি, স্মরণশক্তি ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বলে বিশ্বাস করা হয়। তাছাড়া শিশুর ত্বক, হজমশক্তি ও ঘুমের সমস্যায় প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভর আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা আজও সমান কার্যকর।
এই আধুনিক সময়েও, যেখানে প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে, সেখানে আয়ুর্বেদের মতো একটি প্রাচীন বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়ে দেয় যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকেও সুস্থ থাকা সম্ভব। আয়ুর্বেদ শুধু রোগ সারানোর পদ্ধতি নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচর্চা, যার উদ্দেশ্যই হলো রোগ প্রতিরোধ করা ও শরীরকে এমনভাবে প্রস্তুত করা যাতে সে নিজেই অসুখের সঙ্গে লড়তে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫-এ ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’ এই প্রতিপাদ্যের আলোকে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে- ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ, সচেতন এবং সবল করে গড়ে তুলতে হলে আজ থেকেই মাতৃ ও শিশুর সার্বিক পরিচর্যার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সেই প্রচেষ্টায় আয়ুর্বেদ হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে সমন্বয় করে আয়ুর্বেদকে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দিলে আমরা স্বাস্থ্যসম্মত ও আলোকিত একটি ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারি।
প্রকৃতপক্ষে, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে আয়ুর্বেদিক দর্শনের অন্তর্নিহিত শিক্ষা-সততা, ভারসাম্য, ও প্রাকৃতিকতার প্রতি বিশ্বাস- আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের সুস্থতা আসে দেহ-মন-আত্মার সমন্বয় থেকে। জন্ম সুরক্ষিত রাখার এই যাত্রায় আয়ুর্বেদ হতে পারে এক শক্তিশালী সহচর।
লেখকঃ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সভাপতি, বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএএমএ)
সিলেট বিভাগীয় শাখা
আপনার মতামত লিখুন :